নো ফ্রি লাঞ্চ
হুমায়ুন আহমেদ
‘নো ফ্রি লাঞ্চ’—একটি আমেরিকান বাক্য। এই বাক্যটা বলে তারা এক ধরনের শ্লাঘা অনুভব করে। তারা সবাইকে জানাতে পছন্দ করে যে তারা কাজের বিনিময়ে খাদ্যে বিশ্বাসী।
এই ধরনের বাক্য বাংলা ভাষাতেও আছে—‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’।গায়ে তেল মাখতে হলে কড়ি ফেলতে হবে। আরামের বিনিময়মূল্য লাগবে। যা-ই হোক, ফ্রি লাঞ্চে ফিরে যাই। নো ফ্রি লাঞ্চের দেশে চিকিৎসা করতে ব্যাগ ভর্তি ডলার নিয়ে যেতে হবে, এই তথ্য আমি জানি। তবে বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা বলে যেকোনো হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে হবে। বুকে ব্যথা মানে হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতাল হেলথ ইনস্যুরেন্স আছে কি নেই তা না দেখেই রোগী ভর্তি করবে। চিকিৎসা শুরু হবে। চিকিৎসার একপর্যায়ে ধরা পড়বে রোগীর হয়েছে ক্যানসার। হাসপাতাল তখন ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করবে। রোগীকে ধাক্কা দিয়ে হাসপাতালের ফুটপাতে ফেলে দেবে না। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর বলতে হবে, আমি কপর্দকশূন্য। এক মিলিয়ন ডলার বিল আমি দেব, তবে একসঙ্গে দিতে পারব না। ভেঙে ভেঙে দেব। প্রতি মাসে পাঁচ ডলার করে। এই প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া হাসপাতালের তখন আর করার কিছু থাকে না। বাংলাদেশিদের কাছে এই বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা সংগত কারণেই বেশ জনপ্রিয়।
বাঙালি ব্যবস্থায় আমি চিকিৎসা শুরু করব, এই প্রশ্নই ওঠে না। সমস্যা হচ্ছে, বিপুল অঙ্কের অর্থও তো আমার নেই।
আমার দুটো গাড়ি। দুটোই বিক্রির জন্য পাঠানো হলো। একটা বিক্রি হলো। দখিন হাওয়ার যে ফ্ল্যাটে থাকি, সেটা বিক্রির চেষ্টা করলাম। পারলাম না, ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়ে কিছু আইনগত জটিলতা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে উত্তরায় পাঁচ কাঠার একটা জমি পেয়েছিলাম। সেই জমি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিলাম। লাভ হলো না। বাকি থাকল নুহাশ পল্লী। অর্থ সংগ্রহের ছোটাছুটির একপর্যায়ে অন্যপ্রকাশের মাজহার বলল, আপনি কেন অস্থির হচ্ছেন? আমি তো আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আপনার চিকিৎসার অর্থ কীভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে তা দেখার দায়িত্ব আমার। আপনার না।
আমি বললাম, টাকা কীভাবে জোগাড় করবে? ভিক্ষাবৃত্তি? চাঁদা তুলবে?
মাজহার বলল, না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, কারও কাছ থেকে এক ডলার সাহায্য নেব না। এই মুহূর্তে আমার হাতে ৫০ হাজার আমেরিকান ডলার আছে।
আমি বললাম, দেখাও।
মাজহার বলল, দেখাতে পারব না। ৫০ হাজার ডলার নিউইয়র্কে আপনার জন্য আলাদা করা। চ্যানেল আইয়ের সাগর ভাই আপনার জন্য আলাদা করে রেখেছেন। সাহায্য না, ঋণ। পরে শোধ দেবেন।
আমি খানিকটা ভরসা পেলাম। চ্যানেল আইয়ের সাগরের অনেক বদভ্যাসের (!) একটি হলো শিল্প-সাহিত্যের কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। এই কাজ অতীতেও সে অনেকবার করেছে। এখনো করছে। ভবিষ্যতেও করবে কি না জানি না। ইতিমধ্যে তার উচিত শিক্ষা হয়ে যাওয়ার কথা।
আমেরিকায় অর্থ ব্যয়ের একটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে। হিসাবটা বাংলাদেশি টাকায় দিই।
স্লোয়ান কেটারিং মেমোরিয়ালের ডাক্তাররা আমার কাগজপত্র দেখবেন। রোগ নিয়ে কথাবার্তা বলবেন। শুধু এই জন্য তিন লাখ টাকা জমা দিতে হলো।
ডাক্তার শরীরে মেডিপোর্ট বসানোর জন্য Radio ল্যাবে পাঠালেন। (মেডিপোর্টের মাধ্যমে কেমোথেরাপি শুরু হবে) মেডিপোর্ট বসানোর খরচ হিসেবে জমা দিতে হলো আট লাখ টাকা।
মেডিপোর্ট বসানোর পরদিন কেমো শুরু হবে। আটটি কেমোর পুরো খরচ একসঙ্গে দিতে হবে। টাকার পরিমাণ এক কোটি টাকা। ভাগে ভাগে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
শাওন ও মাজহার দুজনেরই দেখি মুখ শুকনো। নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। যেহেতু তারা আমাকে বলেছে, টাকা-পয়সার বিষয় নিয়ে আমি যেন চিন্তা না করি, আমি তাই চিন্তা করছি না।
কেমোথেরাপি দিতে এসেছি। কেমোথেরাপির ডাক পড়বে, ভেতরে যাব। ডাক পড়ছে না। একা বসে আছি। শাওন আমার সঙ্গে নেই। সে মাজহারের সঙ্গে ছোটাছুটি করছে। শাওন চোখ লাল করে কিছুক্ষণ পরপর আসছে, আবার চলে যাচ্ছে।
একটা পর্যায়ে শাওন ও মাজহার দুজনকে ডেকে বললাম, ‘মার্ফিস ল’ বলে একটি অদ্ভুত আইন আছে। মার্ফিস ল বলে—If any thing can go wrong, it will go wrong. আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা বলো। টাকা কম পড়েছে?
মাজহার বলল, হ্যাঁ। চ্যানেল আইয়ের টাকাটা এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে আমরা অর্ধেক, অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা দিতে চাই, ওরা নেবে না। হাসপাতাল বলছে, পুরো টাকা নিয়ে আসো, তারপর চিকিৎসা শুরু হবে। আমি বললাম, চলো, ফিরে যাই। টাকা জোগাড় করে চিকিৎসার জন্য আসব।
শাওন বলল, তোমার চিকিৎসা আজই শুরু হবে। কীভাবে হবে আমি জানি না, কিন্তু আজই হবে।
শাওন বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করল। আমি বললাম, তুমি সবার সামনে কাঁদছ। বাথরুমে যাও। বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কাঁদো।
সে আমার সামনে থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার ডাক পড়ল, কেমোথেরাপি শুরু হবে। টাকা বাকি থাকতেই শুরু হবে।
সমস্যার সমাধান করলেন পূরবী দত্ত। তিনি হাসপাতালকে বোঝাতে সমর্থ হলেন যে হুমায়ূন আহমেদ নামের মানুষটি চিকিৎসা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানুষ না। তিনি অবশ্যই প্রতিটি পাই-পয়সা শোধ করবেন।
হাসপাতাল চিকিৎসার পুরো টাকা শুরুতেই কেন নিয়ে নেয় তা ব্যাখ্যা করি। অনেক রোগী একটি কেমোর টাকা জোগাড় করে কেমো নিয়ে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। সে বলে, আমার আর টাকা নেই বলে কেমো নিতে পারছি না। আমার চিকিৎসা অসম্পূর্ণ। আমেরিকান হাসপাতাল চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রাখতে পারে না।
পাদটীকা
সর্বাধুনিক, বিশ্বমানের একটি ক্যানসার হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্র কি বাংলাদেশে হওয়া সম্ভব না? অতি বিত্তবান মানুষের অভাব তো বাংলাদেশে নেই। তাঁদের মধ্যে কেউ কেন স্লোয়ান বা কেটারিং হবেন না? বিত্তবানদের মনে রাখা উচিত, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যাংকে জমা রেখে তাঁদের একদিন শূন্য হাতেই চলে যেতে হবে। বাংলাদেশের কেউ তাঁদের নামও উচ্চারণ করবে না। অন্যদিকে আমেরিকার দুই ইঞ্জিনিয়ার স্লোয়ান ও কেটারিংয়ের নাম তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরেও আদর-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবীতে স্মরণ করা হয়।
আমি কেন জানি আমেরিকায় আসার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, হতদরিদ্র বাংলাদেশ হবে এশিয়ায় ক্যানসার চিকিৎসার পীঠস্থান।
যদি বেঁচে দেশে ফিরি, আমি এই চেষ্টা শুরু করব। আমি হাত পাতব সাধারণ মানুষের কাছে।
source :
Priyo Blog |
No comments:
Post a Comment