রং পেন্সিল নিষিদ্ধগাছ হুমায়ূন আহমেদ
ধ্রুব এষের সঙ্গে আমার সখ্য দীর্ঘদিনের। তার চুল-দাড়ি, হাঁটার ভঙ্গি, পোশাক এবং জীবনচর্যা সবই আলাভোলা। তার সম্পর্কে প্রচলিত গল্প হচ্ছে, নিজের বিছানা কারো সঙ্গে 'শেয়ার' করা সম্ভব নয় বলে সে চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আত্মীয়, বন্ধুদের চাপে শেষটায় শর্ত সাপেক্ষে বিয়েতে রাজি হয়। শর্ত হচ্ছে_তার স্ত্রী সারা দিন তার সঙ্গে থাকতে পারবে, কিন্তু সূর্য ডোবার পর পর বেচারিকে তার মায়ের বাড়িতে চলে যেতে হবে। ধ্রুব বিয়ে করেছে। শোনা যায়, তার স্ত্রী শর্ত মেনে নিয়েছে এবং এই দম্পতি সুখেই আছে।
যা-ই হোক, ধ্রুবের কাছ থেকে শোনা একটি লোকগল্প দিয়ে রচনা শুরু করা যাক।
মহাদেব স্বর্গে নন্দিভৃঙ্গিদের নিয়ে আছেন। মহাদেবের মনে সুখ নেই, কারণ কোনো নেশা করেই আনন্দ পাচ্ছেন না। তিনি পৃথিবীতে নেমে এলেন নেশার বস্তুর সন্ধানে। দেখা করলেন লোকমান হেকিমের সঙ্গে, যদি লোকমান হেকিম কিছু করতে পারেন। ইনিই একমাত্র মানুষ, যাঁর সঙ্গে গাছপালারা কথা বলে। মহাদেব এবং লোকমান হেকিম বনেজঙ্গলে ঘুরছেন, হঠাৎ একটা গাছ কথা বলে উঠল। গাছ বলল, লোকমান হেকিম, আমি গাঁজাগাছ। আমাকে মহাদেবের হাতে দিন। মহাদেবের নেশার বাসনা তৃপ্ত হবে। মহাদেব গাঁজাগাছ নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। গাঁজাগাছই একমাত্র গাছ, যা পৃথিবী থেকে স্বর্গে গেল।
এই গাঁজাগাছ আমি প্রথম দেখি বৃক্ষমেলায় বন বিভাগের স্টলে। নুহাশ পল্লীর ঔষধি বাগানে এই গাছ নেই। আমি কিনতে গেলাম। আমাকে জানানো হলো, এই গাছ নিষিদ্ধ। আনা হয়েছে শুধু প্রদর্শনীর জন্য। অনেক দেনদরবার করেও কোনো লাভ হলো না।
আমি গাঁজাগাছ খুঁজে বেড়াচ্ছি_এই খবর ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ তাদের দলে ভিড়েছি বলে বিমল আনন্দ পেলেন, আবার কেউ কেউ আমার দিকে বক্রচোখে তাকাতে লাগলেন। 'ঞযড়ঁ ঃড়ড় ইৎঁঃঁং' টাইপ চাউনি।
জনৈক অভিনেতা (নাম বলা যাচ্ছে না, ধরা যাক তার নাম পরাধীন) আমাকে ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, আপনি গাঁজাগাছ খুঁজে পাচ্ছেন না এটা কেমন কথা! আমাকে বলবেন না? আমি তো গাঁজার চাষ করছি।
আমি বিস্মিত গলায় বললাম, কোথায় চাষ করছ?
আমার ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে। আমার অনেক টব আছে। ফ্রেশ জিনিস পাই। ফ্রেশ জিনিসের মজাই আলাদা।
আমি বললাম, তুমি গাঁজার চাষ করছ, তোমার স্ত্রী জানে?
না। তাকে বলেছি, এগুলো পাহাড়ি ফুলের গাছ। টবে পানি আমার স্ত্রী দেয়।
পরাধীনের সৌজন্যে দুটি গাঁজাগাছের টব চলে এল। যে দিন গাছ লাগানো হলো এর পরদিনই চুরি হয়ে গেল। বুঝলাম, যে নিয়েছে তার প্রয়োজন আমার চেয়েও বেশি।
গাঁজার চাষ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারেও নিশ্চয়ই নিষেধাজ্ঞা আছে। বাংলাদেশ পুলিশ হ্যান্ডবুকে (গাজী শামসুর রহমান) প্রকাশ্যে সিগারেট খেলে ১০০ টাকা শাস্তির কথা বলা হয়েছে। গাঁজা বিষয়ে কিছু পেলাম না। প্রকাশ্যে থুথু ফেললেও ১০০ টাকা জরিমানা। রমজান মাসে মুসলি্লদের থুথু ফেলায় কি আইন শিথিল হবে?
গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সরকার মনে হয় নমনীয়। মাজার মানেই গোল হয়ে গাঁজা খাওয়া। লালনের গান শুনতে কুষ্টিয়ায় লালন শাহর মাজারে গিয়েছিলাম। গাঁজার উৎকট গন্ধে প্রাণ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। এর মধ্যে একজন এসে পরম বিনয়ের সঙ্গে আমার হাতে দিয়ে বলল, 'স্যার, খেয়ে দেখেন। আসল জিনিস। ভেজাল নাই।' সিগারেটের তামাক ফেলে গাঁজা ভরে এই আসল জিনিস বানানো হয়েছে।
গাঁজাগাছ সম্পর্কে কিছু তথ্য। আমার লেখা বৃক্ষকথা নামের বইয়ে বিস্তারিত আছে। এই বইটি অন্যপ্রকাশ থেকে বের হয়েছে। প্রথম দিনের বিক্রি দেখে অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহার অবাক। দ্বিতীয় দিনে অদ্ভুত কাণ্ড। যারা বই কিনেছে, তারা সবাই বই ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে গেছে। তারা হুমায়ূন আহমেদের কাছে গল্প চায়। বৃক্ষবিষয়ক জ্ঞান চায় না। হা হা হা।
গাঁজাগাছের বোটানিক্যাল নাম ঈধহধনরং ঝধঃরাধ খরহহ. গোত্র হলো টৎঃরপধপবধ.
গাঁজাগাছের স্ত্রী-পুরুষ আছে। দুটিতেই ফুল হয়। তবে পুরুষ-গাছের মাদক ক্ষমতা নেই।
স্ত্রী-গাছের পুষ্পমঞ্জুরি শুকিয়ে গাঁজা তৈরি হয়। এই গাছের কাণ্ড থেকে যে আঠালো রস বের হয় তা শুকালে হয় চরস। চরস নাকি দুর্গন্ধময় নোংরা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে খেতে হয়।
স্ত্রী-গাঁজাগাছের পাতাকে বলে ভাং। এই পাতা দুধে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় ভাঙের শরবত, অন্য নাম সিদ্ধির শরবত। এই শরবত ভয়ংকর এক হেলুসিনেটিং ড্রাগ।
আমার বন্ধু আর্কিটেক্ট করিম ভাঙের শরবত খেয়ে কলকাতার এক হোটেলে চবি্বশ ঘণ্টা প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। তার কাছে মনে হচ্ছিল, তার দুটি হাত ক্রমাগত লম্বা হচ্ছে। হোটেলের জানালা দিয়ে সেই হাত বের হয়ে আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে।
গাঁজাগাছের ফুল, ফল, পাতা এবং গা থেকে বের হওয়া নির্যাসে আছে সত্তরের বেশি ক্যানাবিনয়েডস। এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো ক্যানাবিনল, ক্যানাবিডিওল, ক্যানাবিডিন। নাইট্রোজেনঘটিত যৌগ (অষশধষড়রফং)ও প্রচুর আছে।
এসব জটিল যৌগের কারণেই মাদকতা এবং দৃষ্টিবিভ্রম।
যে বস্তু শিব নন্দি ভৃঙ্গিকে নিয়ে হজম করবেন আমরা তা কিভাবে হজম করব! কাজেই 'শত হস্তেন দূরেৎ' (শত হস্ত দূরে)।
মানুষ কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছের কথা জানা গেল। আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছের বিষয়টা কী?
এই নিষিদ্ধ গাছের ফলের নাম 'গন্ধম'। বিবি হাওয়ার প্ররোচনায় আদম এই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়েছিলেন।
সমস্যা হলো গন্ধম আরবি শব্দ নয়। ফারসি শব্দ। পবিত্র কোরআন শরিফে কোথাও এই ফলের নাম নেওয়া হয়নি। হাদিসেও নাম নেই। তাহলে আমাদের কাছে এই গন্ধম কোত্থেকে এল? বাউলরা গান পর্যন্ত লিখলেন, 'একটি গন্ধমের লাগিয়া...।'
যিশুখ্রিস্টের জন্মের চার শ বছর আগে নিষিদ্ধ বৃক্ষ সম্পর্কে লিখলেন ইনক। তার বইয়ে (ঞযব ংবফরঢ়রমৎধঢ়যরপ নড়ড়শ ড়ভ রহড়শ) বলা হয়েছে, এই গাছ দেখতে অবিকল তেঁতুলগাছের মতো। ফল আঙুরের মতো, তবে সুগন্ধযুক্ত।
গ্রিক মিথ বলছে, নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল হলো বেদানা।
রাবি্ব নেসেমিয়া বলছেন, নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল হলো ডুমুর।
ধর্মগ্রন্থ তালমুদ বলছে নিষিদ্ধ ফল আঙুর।
প্রাচীন চিত্রকলায় আদম, ইভ এবং সর্পের সঙ্গে যে ফলটি দেখা যায় এর নাম আপেল।
এখন তাহলে মীমাংসাটা কী?
পাদটীকা : বিষাক্ত ফলের তালিকায় আছে আপেল! আপেলের বিচিতে থাকে বিষ। বিষের নাম সায়ানোজেনিক গ্লাইকোসাইড। একটা বিচি খেলে তেমন কিছু হয় না। একের অধিক খেলে...
No comments:
Post a Comment