হুমায়ূন আহমেদ
আমার শৈশবের অনেক সুখ-স্মৃতির একটি হচ্ছে মা'র সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়া। বিপুল উত্তেজনা, বিপুল আয়োজন। সিলেট শহরের নিয়ম অনুযায়ী বাসার সামনে রিকশা এসে থামত। শাড়ি দিয়ে সেই রিকশা পেঁচিয়ে ঘেরটোপ করা হতো। মহিলারা ঘেরটোপের ভেতরে। শিশুরা তার বাইরে রিকশার পাটাতনে বসে থাকত। কী আনন্দের দিনই না গিয়েছে। সিনেমা হল পর্যন্ত যাবার আনন্দ, সিনেমা হলের ঘণ্টি শোনার আনন্দ, পর্দায় বড় বড় ছবির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুট-বাদাম খাবার আনন্দ।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে গেল।
ফলাফল তেমন কিছু হলো না, তবে আইন পাস হলো এই উপমহাদেশের কোনো ছবি পাকিস্তানে আসবে না। ভারতীয় ছবি বন্ধ হয়ে গেল। সেই সময়কার তরুণ তরুণীরা সুচিত্রা-উত্তমের জন্যে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। তাদের আশা একসময় সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। তখন ছবি দেখা যাবে।
তারপর অনেক দিন পার হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানি বিষাক্ত হয়ে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে, ১৯৬৫ সালের আইন কিন্তু বদলায় নি। এখন আমরা ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারব কিন্তু তাদের ছবি আনতে পারব না।
কারণটা কী?
পাকিস্তানি ভূত আমরা ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছি কেন? উত্তর হচ্ছে দেশের ছবিকে প্রটেকশন দেওয়া। ভারতীয় ছবি এলে আমাদের ছবি বিকশিত হবে না ইত্যাদি। পঁয়তালি্লশ বৎসর আমাদের ছবিকে প্রটেকশন দেওয়ার ফলাফল কী হয়েছে তা সবাই জানেন। এফডিসিতে যেসব রসগোল্লা তৈরি হয়েছে তা আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই চেখে দেখেন নি।
বাংলাদেশী ছবির প্রযোজকরা জানেন, তারা যা তৈরি করবেন দর্শকদের তাই দেখতে হবে। দর্শকদের হাতে কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের ছবির প্রযোজকরা বলেছেন, ভারতীয় ছবি বাংলাদেশে এলে বাংলাদেশের ছবির বারোটা বেজে যাবে। প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারব না। আইন করে আমাদের প্রতিযোগিতার বাইরে রাখতে হবে। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও আমাদের প্রটেকশন দিয়েছেন, ইত্যাদি। সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট বলে যে কথাটি আছে আমাদের দেশে চিত্র নির্মাতা সেটা জানেন না। এই দেশের আইন হলো আনফিটকে সারভাইভ করার সুযোগ দেওয়া। এরচেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে বলে আমি মনে করি না।
এখন যদি লেখকরা বলেন, আমাদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে আমরাও প্রটেকশন চাই। বাইরের কোনো লেখকের বই বাংলাদেশে আসতে পারবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি সেই প্রটেকশন দেবেন? নাকি ছবির প্রটেকশন দিয়ে যাবেন এবং চিত্র নির্মাতারা, "প্রেম না দিলে লাত্থি খাবি?" জাতীয় ছবি বানিয়ে যেতে থাকবেন। এবং একের পর এক আমাদের সিনেমাহলগুলি মার্কেট হতে থাকবে। সাধারণ মানুষের বিনোদন বন্ধ।
কেউ যেন মনে না করেন হিন্দি ছবি দেখার জন্যে আমি ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছি। আমি হিন্দি জানি না এবং হিন্দি ছবির ফর্মুলা পছন্দ করি না। একসঙ্গে তিনশ নর্তক-নর্তকীর নৃত্য আমাকে আলোড়িত করে না। তবে আমার জীবনে দেখা প্রথম ছবিটি একটি হিন্দি ছবি নাম 'বহুত দিন হোয়ে'। এই তথ্যটা না জানালে ভুল হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে আন্তরিক ধন্যবাদ যে দীর্ঘ পঁয়তালি্লশ বছর পার হলেও তিনি একটি শুভ উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোন যুক্তিতে একটি শুভ সূচনার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করলেন তা আমি জানি না। আমি তাঁকে পুনর্বিবেচনা করতেও বলব না কারণ বলে লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সূর্য। তাঁকে ঘিরে থাকবে গ্রহ, উপগ্রহ। তারা প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাবে। প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা এবং পরামর্শ শুনবেন। পত্র-পত্রিকায় যারা লিখবেন তারা গ্রহ-উপগ্রহের বাইরে। কে শুনবে তাদের কথা?
আমি একটি ছোট্ট গল্প দিয়ে লেখার ইতি টানছি। এক চলচ্চিত্র উৎসবে হঠাৎ করে সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ছবিটি এসেছে। বলাকা সিনেমাহলে পরপর কয়েকটি শো হবে। আমি তখন মুহসীন হলের ছাত্র। টিকিটের জন্যে সারারাত হলের সামনে লাইন দিয়ে বসে থাকলাম। সকাল এগারোটায় কাউন্টারের সামনে এসে জানলাম টিকিট শেষ। কি কষ্টটাই না পেয়েছিলাম। ১৯৬৫ সালের একটি ভুল আইনের কারণে একটা ভালো ছবি দর্শকরা দেখতে পেল না।
আমি নিজে একজন শখের ফিল্ম মেকার। অনেকগুলি ছবি বানিয়েছি, আরও বানাব কিন্তু আমি আমার ছবির জন্যে প্রটেকশন চাইব না। অন্য দেশের ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারলে, টিকব না পারলে নাই।
বাংলাদেশের ছবির জগতে এক ধরনের মনোপলি ব্যবসা চলছে। ইসলাম ধর্মে কিন্তু মনোপলি ব্যবসা নিষিদ্ধ।
যাই হোক আমরা পঁয়তালি্লশ বছর পার করেছি। একসময় একশ বছর পার করব। উপমহাদেশের ছবি আমদানি নিষিদ্ধের শতবর্ষ পূর্তি উৎসব হবে। দুর্ভাগ্যবশত প্রাকৃতিক কারণে সেই উৎসবে আমি থাকতে পারব না। একশত বছরের প্রটেকশন পেয়ে আমাদের ছবি কতদূর চলে যাবে তা দেখার একটা শখ অবশ্যি ছিল।
[ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ বৈশাখ ১৪১৭, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩১, ৬ মে ২০১০]
দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত।